র্যামবো ত্রিপুরা;থানচি (বান্দরবান) প্রতিনিধিঃ
বান্দরবান পার্বত্য জেলায় ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের সর্বপ্রথম ব্যাচলর অফ আর্টস (বিএ) পড়ুয়া সত্যরাং ত্রিপুরা প্রধান শিক্ষক সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। তিনি বান্দরবানের রুমা উপজেলা গালেংগ্যা ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের আদিগা পাড়ায় ১২ই সেপ্টেম্বর ১৯৫৭ সনে গবিহা ত্রিপুরা ও দসরুং ত্রিপুরা ঘরে প্রথম সন্তান হয়ে জন্ম গ্রহন করেন।
তিনি আদিগা পাড়া মিশনারী বিদ্যালয়ের প্রাইমারী স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে বান্দরবান সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করেন। ১৯৭৭ সনে তিনি বান্দরবান কলেজে পড়াশুনা শুরু করেন। পরবর্তীতে ঐ কলেজ থেকে বান্দরবান জেলায় ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের মধ্যে সর্বপ্রথম ব্যাচলর অফ আর্টস (বিএ) পরীক্ষায় অংশ গ্রহনকারী হিসেবে অংশ গ্রহন করেন। তিনি বিএ পর্যন্ত পড়াশুনা করার পর পড়াশুনা ছেড়ে দেন।
কর্ম জীবনে প্রথমে তিনি নিজের এলাকায় মিশনারী স্কুলে শিক্ষকতার সাথে যুক্ত হন। পরে ১৯৮৪ সালে সহকারী শিক্ষক পদে নিয়োগ প্রাপ্ত হন। ট্রেনিং পাওয়ার পর তিনি পদোন্নতি হয়ে প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগ প্রাপ্ত হন। দীর্ঘ ৩৩ বছর শিক্ষকতা করার পর ২০১৭ সালে অবসর গ্রহন করেন।
এ বিষয়ে থানচি সদরের তিমং পাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সত্যমনি ত্রিপুরা বলেন, আমি সরকারী শিক্ষক নিয়োগ পাওয়ার পর বলিপাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম পোষ্টিং হয়। সেই সময় আমি ও সত্যরাং মাষ্টার একই সাথে শিক্ষকতা করেছি। তবে তিনি প্রথমে মিশনারী স্কুলে ছিলেন। মিশনারী স্কুলে ১৭৫ টাকা বেতনে প্রথম চাকরী করতেন তিনি।
১৯৮৪ সনে থানচিতে একজন সহকারী শিক্ষক শূন্য পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হলে আমি তাকে উপজেলা শিক্ষা অফিসার সাথে যোগাযোগ করে দিয়ে আবেদন করায়। পরে তিনি সহকারী শিক্ষক পদে নিয়োগ পেয়ে যান। থানচি বলিপাড়া ইউনিয়নের বলিবাজার সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তিনি দীর্ঘদিন যাবত শিক্ষকতা করার পর ২০১৭ সালে অবসর গ্রহন করেন। তিনি আমার খুব ভাল সহকর্মী ছিলেন। মৃত্যুর আগেও আমার সাথে মোবাইলে কথা হয়েছিলো। তিনি এই বয়সে এভাবে সবাইকে ছেড়ে চলে যাবে আমি ভাবতেও পারিনি। সত্যরাং মাষ্টার ছিলেন পাহাড়ী, বাঙালী সবার প্রিয় মানুষ। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন, এডভোকেট ও ইউএনডিপি বান্দরবান জেলা ম্যানেজার খুশিরায় ত্রিপুরা, বলিপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জিয়াঅং মারমাসহ আরো অনেকেই বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের, ব্যবসায় কর্মরত আছেন।
তাঁর ছাত্র ৪নং বলিপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার মোঃ আকতার হোসেন তিনি তার ব্যক্তিগত ফেসবুক মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে লিখেছেন, শেষ বিদায় জানাতে প্রিয় শিক্ষকের পাশে থাকতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করি।
তাঁর আরেক ছাত্র ও ভাগিনা বেনেডিক্ট ত্রিপুরা সহকারী শিক্ষক ফেসবুকের স্টাটাস দিয়ে লিখেছেন, ওপারে ভালো থেকো মামা। তুমিই আমাদের পদ প্রদর্শক। তোমার হাত ধরে হাঁটতে শিখেছি আজ আমরা অবিভাবকহীন। তবুও তোমার আদর্শকে সামনে রেখে চলবো।
তার আদরে সবার ছোট মেয়ে রিতা ত্রিপুরা তার অনুভূতি জানিয়ে তাঁর ফেসবুকে বাবাকে লিখেছেন, বাবা, তুমি কেন এইভাবে অভিমান করে চলেগেলে ? তুমিতো চেয়েছিলে তোমার আশেপাশে তোমাকে ঘিরে সব সন্তানরা যেন সংসার করে। আমি যে তোমার পাশে থাকবো বলে ছোট একটা ঘর তুলেছি, মাত্র এক মাস হলো আজ, আগামী সাসে সেই ঘর আর্শীবাদ করবো বলে কথা হয়েছিল কালকে। আজ সেই ঘরটিতে তোমার শেষ বিদায়ের অনুষ্ঠান করতে হবে কখনো ভাবিনী বাবা। আজ আমরা অনাথ হলাম। প্রিয় মাষ্টারকে এক পলকে দেখার জন্য এবং বিদায় জানাতে পাহাড়ী, বাঙালী,সহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের শতশত তাঁর প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীরাসহ ভক্তরা চির বিদায় জানাতে উপস্থিত হয়েছিলেন।
তিনি দীর্ঘদিন ডাইবেটিস, হাইপ্রেসার ও চোখের সমস্যায় ভূগছিলেন। গত ১৪ই জুলাই ভোর ৫টায় ষ্ট্রোক করে মৃত্যু বরণ করেন। সত্যরাং মাষ্টারের মৃত্যুতে বড় জামাতা মনিরাম রাফায়েল ত্রিপুরা প্রধান শিক্ষক ক্যচু পাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়,ও ভক্তজনরা তার আত্মার চির শান্তির জন্য সৃষ্টিকর্তার নিকট প্রার্থনা করেন। মরে যাওয়ার সময় তাঁর স্ত্রী, এক ছেলে, তিন মেয়ে, সাত নাতি-নাতনীদের রেখে গেছেন।