আয়েশা সিদ্দিকা, ক্যাম্পাস প্রতিনিধি:
প্রতিটি বাবা-মায়ের স্বপ্ন থাকে তাদের সন্তান দেশের সেরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে পড়বে,ভাল চাকরি করবে,বাবা মায়ের মুখ উজ্জ্বল করবে।আর দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর মধ্যে অন্যতম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।অনেক শিক্ষার্থীর কাছে চবি হলো স্বপ্নের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ।হাজারো স্বপ্ন নিয়ে শিক্ষার্থীরা যখন চবিতে ভর্তি হয়,তাদের চোখে মুখে থাকে বারুদের মতো তীব্র রুপ। আর সেই রুপই তাদের নিয়ে যায় জীবনের প্রতিটি স্বপ্নের ক্যানভাসে।কিন্তু সেই স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয় যখন স্বপ্ন নিয়ে ছিনিমিনি করে, তখন ভেঙ্গে যায় হাজারো স্বপ্ন বা হাজারা বাবা-মায়ের আকাঙ্ক্ষা,হাজারো মধ্যবিত্ত পরিবারের সারাজীবনের পরিশ্রম।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় দেশের সেরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর মধ্যে একটি।আর এই বিশ্ববিদ্যালয়ের (IER) বিভাগে এ ঘটে সেই স্বপ্নের ছিনিমিনি খেলা।২৫মাসেও অনুষ্ঠিত হয় নি(IER) ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের পরীক্ষা। একটা স্বনামধন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এর একটা ইন্সটিটিউট তার শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা নিতে না পারা এই ব্যর্থতা কার? সেশন জট কোন শিক্ষার্থীর কাম্য নয়।একজন শিক্ষার্থীর পড়ালেখা শেষ হতে যদি ৭-৮বছর লেগে যায়,তাহলে সেই শিক্ষার্থী কিভাবে দেশের,সমাজের,পরিবারের ও নিজের স্বপ্ন পূরণ করবে।এমনি দাবি চবির আইইআর বিভাগের অনেক শিক্ষার্থীদের।
চবির আইইআর বিভাগের এক শিক্ষার্থীর ফেবু স্ট্যাটাস এ দেখা যায় সেই করুণ আকুতি।সেই শিক্ষার্থী তার ফেবু স্ট্যাটাস এ লিখেন,” আমার সেশন২০১৭-১৮। ভর্তি পরীক্ষায় B,D উভয় ইউনিটেই উত্তীর্ণ হয়েছিলাম। কিন্তু পছন্দের সাবজেক্ট ছিলো শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট। ভর্তি হয়ে গেলাম। তারপর ক্লাস, ইনকোর্স সব কিছু ভালোভাবেই চলছিলো। হুট করে (সম্ভবত জুন অথবা জুলাই মাসে) শুনি ইনস্টিটিউট থেকে পরিচালক সহ আঠারোজন শিক্ষককে বহিস্কার করা হয়েছে। দুই-তিন মাস ক্লাস অফ থাকলো। তারপর, বিভিন্ন ডিপার্টমেন্ট থেকে শিক্ষকরা এসে ক্লাস নিতে থাকলেন। প্রায় শেষ হওয়া কোর্স আবার নতুন করে শুরু করা হলো। গেস্ট টিচারদের অভিযোগের অন্ত ছিলো না। যেমনঃ তোমাদের ডিপার্টমেন্টে মাল্টিমিডিয়া ক্লাস রুম নেই, তোমাদের ডিপার্টমেন্ট অনেক দূরে, ল্যাব নেই। অগত্যা, কোর্স শেষ করা এবং তাড়াতাড়ি প্রথম বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা দেয়ার তাগিদে বিভিন্ন গেস্ট টিচারদের ডিপার্টমেন্টে গিয়ে ক্লাস করতে থাকলাম। অনেক সময় দেখা যেতো আমরা ইনস্টিটিউট থেকে ক্লাস করে অন্য ডিপার্টমেন্টে গিয়ে ক্লাস করতাম আবার ইন্সটিটিউটে এসে আরেকটা ক্লাস করতাম। এসব কিছুই করেছি, শুধুমাত্র তাড়াতাড়ি ফাইনাল পরীক্ষা দিবো বলে। দেখতে দেখতে ডিসেম্বরের মধ্যেই কোর্স শেষ হয়ে গেলো। পরীক্ষা দেয়ার জন্য ডিপার্টমেন্টের স্যারদের অনুরোধ করতে থাকলাম। কিন্তু তখন পর্যন্ত ইনস্টিটিউটের নব্য ডিরেক্টর কে দেখা কিংবা তার সাথে কথা বলার মত সুযোগ হয়নি।
অন্য ডিপার্টমেন্টে গিয়ে ক্লাস করার ব্যাপারে আমাদের স্যারদের অবহিত করা হলেও তারা নীতিবাক্য শোনানো ছাড়া আর কিছুই করতে সক্ষম হননি। অবশেষে ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে শুরু হলো ১ম বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা। পরীক্ষার সময় এই এটেনডেন্সজনীত সমস্যা হলেও জরিমানা এবং মুচলেকার বিনিময়ে পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ মেলে আমাদের। দীর্ঘ সাত-আট মাস পর আমাদের বার্ষিক পরীক্ষার রেজাল্ট দেয়া হয় ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে।
এরপর ২য় বর্ষের কোর্স গুলো তাড়াতাড়ি শেষ করার জন্য ডিরেক্টর স্যারের সাথে দেখা করতে যাই। বলা বাহুল্য, উনার আচরণে আমরা হতাশ হয়ে যাই। উনাকে অনেক বার অনুরোধ করা সত্ত্বেও টলানো যায় নি। উনি ফর্মাল কথা বার্তা বলতেই থাকেন। বলেন বিশ্ববিদ্যালয় নাকি এভাবেই চলে, আমাদের না পোষালে অন্য জায়গায় ভর্তি হতে বলেন, উনি নিজেও দশ বছরে অনার্স পাস করেছেন ইত্যাদি ইত্যাদি। বলেন যে তোমাদের একাডেমিক ক্লাস নেয়ার জন্য বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টে চিঠি পাঠিয়েছি, উনারা মিটিং করে আমাদের জানাবেন।
মাসখানেক পর আমাদের ক্লাস শুরু হয়, তারপর আবার সেই আগের মতই অন্য ডিপ্টে গিয়ে ক্লাস করা। কয়েকজন সিনিয়র টিচার আগ থেকেই জানিয়ে দেন যে যদি উনাদের ডিপার্টমেন্টে না যাই তাহলে ক্লাস নিবেন না। এই বিষয়ে আমাদের স্যারদের বলার পর ও কোনো সুবিধা হয়নি। ছোট একটা উদাহরণ দেই, রবিবারে আমাদের প্রায় সবগুলো ক্লাস হতো। সকাল ৯ টায় থাকতো বোটানি ক্লাস, সেটা হতো বায়োলজি ফেকাল্টিতে। তারপর রসায়ন ক্লাস, সেটা হতো সাইন্স বিল্ডিংয়ে। এরপর ফিজিক্স ক্লাস, ওটাও হতো সাইন্স বিল্ডিংয়ে।
তারপর হতো বাংলা, আর্টস ফেকাল্টিতে। তারপর আমরা সেই আর্টস ফেকাল্টি থেকে চলে আসতাম আইইআরে আমাদের প্রফেশনাল কোর্স গুলোর কারনে। মোটামুটি ক্লাস করতে করতে প্রতিদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছোট খাটো একটা করে ট্যুর হয়েই যেতো। অনেক সময় আবার আইইআরে ক্লাস করে সাইন্স বিল্ডিং, অতপর আবার আইইআরে আসতে হতো ক্লাস করার জন্য।
বর্তমানে আমি কোন বর্ষে আছি আমি আসলেই জানি না৷ কেননা, দ্বিতীয় বর্ষে ভর্তি হওয়ার সুযোগ মেলেনি এখনো। গতকাল ২০১৮-১৯ সেশনের ১ম বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা স্থগিত করা হয়।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে আমার একটা মিনতি, যদি এটেনডেন্সের নিয়ম কড়াকড়ি ভাবে আরোপ করা হয়, তবে সারা বছর মাত্র কয়েকটা ক্লাস নিয়ে ৬০ টা ক্লাসের এটেনডেন্স বানানো কতটা যৌক্তিক; একটু ভেবে দেখবেন। আর ২৫ মাস এক বর্ষে থাকার পর বিষয়টা মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে একটু বিবেচনা করবেন।
এখানেই শেষ নয়, আমি নিজেও ২ বছর ধরে দ্বিতীয় বর্ষে আটকে আছি(দ্বিতীয় বর্ষে ভর্তি হতে পারিনি)। শুধু তাই নয়, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সব গুলো ব্যাচেরই একি অবস্থা।
প্রশ্ন রেখে গেলাম, কবে নাগাদ আমাদের এই অচলাবস্থা শেষ হবে৷ কবে আমরা আমাদের নিজ ইনস্টিটিউটে সব ক্লাস করার অধিকার পাবো। কবে ১২ মাসে এক বছর ধরার অধিকার পাবো?
এ দিকে পরীক্ষা স্থগিতের ঘোষণা শুনেই কান্নায় ভেঙে পড়েন শিক্ষার্থীরা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে আইইআরের প্রথম বর্ষের একাধিক শিক্ষার্থী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, গতকাল আমরা যখন ১১ শিক্ষার্থীর বিষয়ে আবেদন নিয়ে গেছি, তখন একাধিক শিক্ষক আমাদের পরীক্ষা স্থগিত করে দেবেন বলে হুমকি দিয়েছিলেন। আজ তাই হলো। তারা আমাদেরকে বলেছিলেন, তোমরা আন্দোলন করে আমাদের সম্মানহানি করতেছ। আমরা চাইলে তোমাদের পরীক্ষা স্থগিত করে দিতে পারবো। তখন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তো দূরের কথা, আরও উপরের কেউ আসলেও আমাদের পরীক্ষা নেওয়াতে পারবে না। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমাদের কী করতে পারবে? আমাদের কাছে আগে সম্মান বড়।
আশা করি শীঘ্রই চবিতে আইইআর ১ম বর্ষের পরীক্ষা শুরু হবে।শিক্ষার্থীরা জটমুক্ত সেশন পাবে।