মোঃ সিরাজুল মনির,চট্টগ্রাম ব্যুরো প্রধান।
করোনা ভাইরাস পরিস্থিতির কারণে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজের অগ্রগতি না থাকলে ও তিন বছর মেয়াদি চট্টগ্রাম জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের কাজ এখন রাতদিন চালিয়ে যাচ্ছে ঠিকাদাররা। এতদিনে প্রকল্পের পুরো কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু করোনার কারণে প্রায় কয়েকমাস কাজ বন্ধ রাখাতে কাজের গতি কমে গেছিল। চট্টগ্রাম নগরীর ‘জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন’ মেগাপ্রকল্পের বর্তমান চিত্র হলো পুরনো খালগুলো উদ্ধার এবং অনেক নতুন কেঠে এ প্রকল্পের বাস্তবায়ন করতে হচ্ছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে। তবে অভিযোগ রয়েছে ১৫টির অধিক প্রতিষ্ঠান এই প্রকল্পের কাজ পেলেও এখনো কয়েকটি প্রতিষ্ঠান কাজের গতি বাড়াতে পারেনি।
এদিকে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর অভিযোগ, প্রকল্পটির বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান সিডিএ’র প্রকল্পের নকশা প্রণয়নে দেরি এবং ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে হস্তান্তরে সময়ক্ষেপণের কারণেই প্রতিষ্ঠানগুলো সময়মতো কাজ শুরু করতে পারেনি। এছাড়া পরামর্শক প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর এন্ডভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফি ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (সিইজিআইএস) অসযোগিতার কারণেও বেশিরভাগ ঠিকাদার কাজ শুরু করতে দেরি হয়েছে। তবে সিডিএ’র দাবি, পরামর্শক প্রতিষ্ঠান গত এপ্রিলে বিস্তারিত নকশা বুঝিয়ে দিয়েছে। এরপরই তারা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে নকশা বুঝিয়ে দিয়েছে।
এই প্রসঙ্গে সিডিএ’র প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী আহমেদ মঈনুদ্দিন তিনি বলেন প্রকল্পটি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তদারকি করছে তাই সবকাজে গতি আছে। তিনি বলেন করোনার কারণে কাজ বন্ধ থাকলে ও এখন কাজের অনেক বেড়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৫টির অধিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে স্পেক্ট্রা, এনডিই ও বিশ্বাস ট্রেডিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছে পুরোদমে। আমেনা গ্রুপ, বিবিএল-বিটিসি-এমএলবি জয়েন ভেঞ্চার ও ই ইঞ্জিনিয়ারিংসহ অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো এখনও কাজ পুরো গতিতে চালাচ্ছে না। তবে প্রকল্প শুরুর পর থেকে এখনও খালগুলোর পুনঃখনন কাজও পুরোপুরি শুরু হয়নি। খালের পাশে প্রতিরোধ দেয়াল ও রাস্তা নির্মাণসহ অন্যান্য কাজও চলছে ধীরগতিতে।
বিশ্বাস বিল্ডার্সের প্রতিষ্ঠান মেসার্স বিশ্বাস ট্রেডিং অ্যান্ড কানস্ট্রাকশন নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে নগরের ১০টি খালের উন্নয়নের জন্য কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছিল। খালগুলো হলো- রাজাখালী-১, রাজাখালী-২, সদরঘাট-১, সদরঘাট-২, চাক্তাই ডাইভারশন, বাকলিয়া, টেকপাড়া, ফিরিঙ্গীবাজার ও মোগলটুলী খাল। কার্যাদেশের মেয়াদ এই বছরের ৩১ ডিসেম্বর শেষ হওয়ার কথা ছিল। প্রতিষ্ঠানটি কোনও খালের কাজই এখনও শেষ করতে পারেনি। দুটি খালের আংশিক কাজ শেষ হয়েছে। একই অবস্থা এনডিই লিমিটেডের। এই প্রতিষ্ঠান ছয়টি খালের কাজ পেয়েছে। তিনটি খালে কাজ শুরু করলেও এখন পর্যন্ত বাকি তিনটির কাজ শুরুই করতে পারেনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই প্রকল্পের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, সিডিএ সময় মতো ডিজাইন না বুঝিয়ে দেওয়ার কারণেই জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব হচ্ছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কোনোভাবেই এই প্রকল্প শেষ করা সম্ভব নয়।
এই প্রসঙ্গে প্রকল্প পরিচালক সিডিএ’র নির্বাহী প্রকৌশলী আহমদ মঈনুদ্দিন বলেন, ‘প্রকল্পের অধীনে ৩১টি খালের পূর্ণাঙ্গ নকশা প্রণয়ন করতে এক বছর সময় লেগেছে। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান গত বছরের এপ্রিল মাসে বিস্তারিত নকশা বুঝিয়ে দেয়। এরপর আমরা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে বুঝিয়ে দিয়েছি। প্রকল্পটি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তদারকি করছে।
এই প্রসঙ্গে জানতে মেগা প্রকল্পের দায়িত্বে থাকা সেনাবাহিনীর প্রকল্প পরিচালক কর্নেল শাহ আলী বলেন,
২০১৭ সালের আগস্ট মাসে ৫ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে সিডিএ’র ‘চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন’ শীর্ষক একটি প্রকল্পের অনুমোদন দেয় একনেক। তিন বছর মেয়াদি এই প্রকল্প বাস্তবায়নের শেষ সময় ছিল ২০২০ সালের জুন মাস। করোনা পরিস্থিতিতে কাজ বন্ধ কিছু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম সহ যথাসময়ে প্রকল্পটি শেষ করা সম্ভব হয়নি বলে মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। এখন অনেক ঠিকাদার রাতদিন কাজ চালিয়ে যাচ্ছে তাই বাড়ানো মেয়াদের মধ্যে কাজ শেষ করে একটি সুন্দর প্রকল চট্টগ্রাম বাসীকে উপহার দিতে পারব। তিনি আরো বলেন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ২০১৮ বছরের ৯ এপ্রিল সেনাবাহিনীর সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি (এমওইউ) স্বাক্ষর করে সিডিএ। এরপর ২৮ এপ্রিল প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। প্রকল্পের অধীনে ৩৬টি খাল খনন করা হচ্ছে।
এই প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান সিইজিআইএসের আবাসিক প্রকৌশলী শেখ আব্দুল মমিন বলেন, ‘একটি প্রকল্প যেসব প্রক্রিয়া অনুসরণ করে বাস্তবায়ন করা হয়, জলাবদ্ধতা প্রকল্পের ক্ষেত্রে সেটি হয়নি। প্রথম দিকে প্রকল্পের ডিজাইন শেষ করার আগেই ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল । এরপর তারা ঠিকাদার নামিয়ে দিয়েছিল কিছু না বুঝে, তখন কিন্তু ঠিকাদারের কাছে রেট ছিলনা, ডিজাইন ছিলনা । কীভাবে কাজটা সম্পাদন করবে, তার কোনও আউট লাইন ছিলনা। তড়িঘড়ি করে তাদেরকে কাজ করার জন্য মাঠে নামিয়ে দিয়েছিল। এ কারণেই ঠিকাদাররা তখন ঠিকভাবে কাজ শুরু করতে পারেনি দেরি হয়ে গেছিল কাজ শুরু করতে।
প্রকৌশলী শেখ আব্দুল মমিন আরও বলেন, ‘যাই হোক দেরি করে হলেও ডিজাইন দেওয়া ডিজাইন দেওয়ার পর কাজ শুরু করে এখন চলমান রয়েছে । এবং শুরুতে যে ডিজাইনটা তাদের হাতে দেওয়া হয়েছে আমরা মাঠে নিরীক্ষা চালিয়ে দেখেছিলাম , ওই রিপোর্টগুলো বাস্তবসম্মত ছিলনা। কারণ চট্টগ্রাম নগরীর মাটি খুব ভালো নয়। আমরা যখন সয়েল টেস্ট করে আবার ডিজাইন তৈরি করলাম। তারা যে সম্ভাব্য খরচ ধরে কাজটা নিয়েছিল, সেটিও ঠিকভাবে ।
প্রকৌশলী শেখ আব্দুল মমিন বলেন, ‘রাজাখালী খালের কল্পলোক অংশে আমরা পাইলিং ছাড়াই রিটেইনিং ওয়াল তুলতে পেরেছি। কিন্তু, অন্যান্য খালে এটি করা যায়নি ঠিকভাবে । খালগুলোর মাটি এত নরম, সেখানে পাইলিং করে তারপর রিটেইনিং ওয়াল তুলতে হবে। এরকম অনেক জায়গায় ডিজাইন পরিবর্তন করতে হচ্ছে।
প্রসঙ্গত চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষ বর্ষাকালে আধা পানিতে ডুবে থাকে একটু বৃষ্টি হলেই। আওয়ামীলীগ সরকারের প্রতিশ্রুতির ধারাবাহিক কাজের অংশ হচ্ছে এ জলাবদ্ধতা প্রকল্প। চট্টগ্রামের যথগুলো মেগা প্রকল্প রয়েছে জলাবদ্ধতা প্রকল্প অন্যতম। এ নগরীর সাধারণ মানুষের দাবি আগামী বর্ষা মৌসুমে আর যাতে পানিতে ডুবে থাকতে না হয়।