উথোয়াইচিং মারমা;বান্দরবান প্রতিনিধিঃ বান্দরবানে ম্রো সম্প্রদায়ের ক্রামা ধর্মাবলম্বীদের বার্ষিক ‘ক্রামা ধর্মীয় সম্মেলন’ অনুষ্ঠিত হয়েছে। ‘‘১৯৮৬ সালে প্রথম সম্মেলন সদর উপজেলা টংকাবতি ইউনিয়নে বাইট্যাপাড়ায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এরপর থেকে প্রত্যেক বছর শেষের দিকে এই সম্মেলনটি ক্রামাদি পাড়ায় হয়ে আসছে।‘‘ক্রামা ধর্ম আশি দশকের সময় মেনলে ম্রো নামের এক তরুণ এ ধর্মটি প্রবর্তন করে যান।
মঙ্গলবার সকালে জেলা শহর থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে চিম্বুক পাহাড়ের ক্রামাদি পাড়ায় ধর্মীয় নানান আনুষ্ঠানিকতায় এ সম্মেলন শুরু হয়।
সম্মেলনের সমন্বয়ক পাকো ম্রো জানান, পাঁচটি বিষয় ঘিরে এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে সামাজিক রীতিনীতি, সামাজিক বিচার, সামাজিক আইন শৃঙ্খলা, চিকিৎসা ও শিক্ষা বিষয়ক। মেনলে ম্রোর শিষ্য একজন করে এসব বিভাগের প্রধান দায়িত্ব হিসেবে থাকে। বাকী একজনকে সহকারী হিসেবে রাখা হয়।
তিনি আরো বলেন, সম্মেলনে অংশগ্রহণ করতে আসা বেশির ভাগ অতিথিদের বাড়ি দূরের হওয়ায় গতকাল থেকে পাড়ায় উপস্থিত হয়েছিল। সে রাতে ম্রোদের ঐতিহ্যবাহী বাঁশি নৃত্য ও গানের অনুষ্ঠান আয়োজন হয়েছিল। আজ দুই পর্বে দিনব্যাপী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
প্রথম পর্ব শেষে সামাজিক রীতিনীতি নিয়ম তৈরির দায়িত্ব পাওয়া সহকারী থংওয়াই ম্রো জানান, পাড়ায় অনেক সময় সামাজিক বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। কেউ কেউ রীতিনীতি ভঙ্গ করে। এসব বিষয়ে কিভাবে সামাল দেওয়া যায় সেসব বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। তবে সামাজিক বিচারিক দায়িত্বে যারা রয়েছে শাস্তির জন্য তাদের কাছে নিয়ম ভঙ্গকারীদের তুলে দেওয়া হয় বলে জানান তিনি।
চিকিৎসা বিষয়ে দায়িত্ব পাওয়া প্রধান ব্যক্তি লেংরিং ম্রো জানান, বর্তমানে মহামারী ছোঁয়াচের রোগ প্রার্দুভাবের কারনে করোনা ভাইরাস বিষয়টি বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে কিভাবে মহামারী রোগ থেকে বাঁচানো যায় এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়ে পাড়াবাসীদের সচেতনতা করার বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। ‘‘প্রত্যেক পাড়াবাসীদের এসব ব্যাপারে আবারও সচেতন হওয়ার জন্য বলা হবে।’’
শিক্ষা বিষয়ে দায়িত্ব প্রাপ্ত রেংছং ম্রো জানান, প্রত্যেক ম্রো পরিবার থেকে মাসিক দশ টাকা করে অর্থ সংগ্রহ করবে তারা। বছর শেষে সংগ্রহ করার টাকায় ম্রো ভাষায় বই ছাপানো হবে। ‘‘এসব বইয়ে ক্রামা ধর্মীয় জ্ঞান, ধর্মীয় আচার-আচরণ, সামাজিক আচরণবিধি, বিধি নিষেধ এবং কিছু উপদেশমূলক কথা থাকবে। এছাড়া ম্রো ভাষার শিক্ষা সবাই যাতে পড়ার সুযোগ পায় সে ব্যবস্থাও করা হবে। ’’ক্রামা ধর্মাবলম্বীদের বার্ষিক এ সম্মেলনে সিদ্ধান্তসমূহ যার যার এলাকায় প্রচার করা হবে। সে সাথে ম্রো সমাজে এগুলো রীতিনীতি হিসেবে প্রয়োগ করা হবে জানিয়েছেন পাঁচটি বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধানরা।
এদিকে ম্রো ভাষার লেখক ও গবেষক ইয়াঙান ম্রো জানান, আশির দশকের সময় মেনলে ম্রো ক্রামা ধর্মটি প্রবর্তন করেন। ‘ক্রামা’ অর্থ অসীম জ্ঞানের অধিকারী। সুয়ালক ম্রো কমপ্লেক্স স্কুলে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়া মেনলে ম্রো ছিলেন বিভিন্ন বিষয়ে গভীর জ্ঞান রাখার একজন ধারক ও বাহক। যিনি লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে মাসের পর মাস ধ্যান করতেন বটগাছের নিচে।
‘‘পরবর্তীতে ম্রো জনগোষ্ঠীর জন্য ধ্যান করে সাধনার মাধ্যমে পাওয়া ‘ক্রামা ধর্ম’ নামে একটি নতুন ধর্ম প্রবর্তন করেন। সেই সঙ্গে তৈরি করেন ধর্ম পালনের জন্য বিভিন্ন নিয়ম ও রীতিনীতি। এ ধর্ম প্রবর্তনের পাশাপাশি সেই সময় তিনিই প্রথম রচনা করেন ম্রো ভাষার বর্ণমালা। পরে শিষ্য তৈরি করে তাদের মাধ্যমে বিভিন্ন এলাকায় ম্রো বর্ণমালা ও ক্রামা ধর্ম প্রচারণা শুরু করা হয়েছিলো।’’
‘‘মেনলে ম্রোর জন্ম ১৯৬৫ সালে চিম্বুক পাহাড়ে পোড়া বাংলা পাড়ায়। যার নাম এখন ক্রামাদি পাড়া নামে পরিচিতি পেয়েছে। সেখানে থাকা অবস্থায় আরও কঠোর ধ্যান করার উদ্দেশ্যে ১৯৮৪ সালে মাত্র ১৯ বছর বয়সী মেনলে হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে যায়।’’
ইয়াঙান ম্রো আরো জানান, তাকে ঘিরে ম্রো সমাজে নানারকম কিংবদন্তী কাহিনি রয়েছে। আমাদের সবার বিশ্বাস ভবিষ্যতে একদিন আবার ফিরে আসবেন তিনি।“ক্রামা ধর্ম’ প্রবর্তনের আগে পাহাড়ে জুমচাষ করে আসা এই ম্রো জনগোষ্ঠীর বেশির ভাগ ছিলেন প্রকৃতি পূজারী। এর বাইরে কিছু বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীও ছিলেন।
সামাজিক সংগঠন ম্রো সোশ্যাল কাউন্সিলের মতে, ২০১১ সালের আদমশুমারীতে ম্রো জনসংখ্যা ছিল ৩৯,৬৫৬ জন। কিন্তু নিজেদের উদ্যোগে করা জরিপে ২০০৫ সালে তাদের সংখ্যা ৬৭, ৩৭৬ জন পাওয়া গেছে।