অবরুদ্ধ কিয়েভ সরকারকে অস্ত্র দেওয়ার জন্য ন্যাটোর দেশগুলোকে নাটকীয়ভাবে যুদ্ধাস্ত্র সরবরাহ বাড়িয়েছে বিশ্বের শীর্ষ অস্ত্র ব্যবসায়ী দেশ যুক্তরাষ্ট্র। বড় পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলোর মধ্যে যুদ্ধ এড়াতে ইউক্রেনের নো-ফ্লাই জোন করার আহ্বান প্রত্যাখ্যান করলেও আগ্নেয়াস্ত্র দেওয়া বাড়িয়েছে বাইডেন প্রশাসন। মূলত এর মাধ্যমে যুদ্ধের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে পশ্চিমা বিশ্ব। তবে ইউক্রেনীয়দের ওপর চলা সহিংসতা বন্ধে যুক্তরাষ্ট্রের এমন কর্মপন্থা সহায়তা করবে কিনা- তা নিয়ে এখন নিজেদের প্রশ্ন করতে হবে পশ্চিমাদের।
সংবাদমাধ্যম দ্য ইন্টারসেপ্টের এক বিশ্নেষণে গবেষক জেরেমি স্কাহিল বলেছেন, ইউক্রেনে রাশিয়ার ভয়াবহ হামলার মধ্যে পশ্চিমাদের সামরিক জোট ন্যাটোর সরকারগুলোর ব্যাপক তৎপরতা সত্ত্বেও পশ্চিমাদের ভূমিকা কখনও বেশি কখনও কম প্রচার করেছে বেশিরভাগ সংবাদমাধ্যম। অথচ দশক ধরে মস্কো ও ওয়াশিংটনের ‘প্রক্সি যুদ্ধক্ষেত্র’ হিসেবে ইউক্রেন ব্যবহূত হয়ে আসছে। এখন যদি যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে পূর্ণমাত্রার যুদ্ধ না হয়; তাহলে পশ্চিমাদের বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের নিজেদের প্রশ্ন করা উচিত- অবরুদ্ধ ইউক্রেনীয়দের ওপর চলা সহিংসতা বন্ধে কি এই অস্ত্র সরবরাহ ব্যবস্থা সহায়তা করবে?
ওবামা প্রশাসন ইউক্রেনকে প্রাণঘাতী আগ্নেয়াস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করেছিল। কারণ এ পদক্ষেপকে উস্কানি হিসেবে বিবেচনা করবেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভদ্মাদিমির পুতিন। ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখলের পর দেশটিকে কিছু সামরিক ও গোয়েন্দা সহায়তা দেওয়া শুরু করে ওয়াশিংটন। পরে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হয়ে অস্ত্র সরবরাহ বাড়ান। জো বাইডেন এসে পরিমাণ আরও বাড়িয়ে দেন। আক্রমণ শুরুর আগে বাইডেন প্রশাসন প্রাণঘাতী অস্ত্র সহায়তা দেওয়া বহু গুণ বাড়ায়।
২০২১ সালে স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি তথা ৬৫০ মিলিয়ন ডলারের সহায়তায় অনুমোদন দেন বাইডেন। হামলার শুরুর দু’দিন পর ৩৫০ মিলিয়নের প্যাকেজ ঘোষণা দেন তিনি। বৃহস্পতিবার আরও সাড়ে ১৩ বিলিয়ন ডলারের সহায়তায় অনুমোদন দেয় যুক্তরাষ্ট্র। সর্বশেষ গত শনিবার আরও ২০ কোটি ডলার সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন বাইডেন। মূলত অস্ত্র কেনার জন্য এসব অর্থ কিয়েভকে দিচ্ছে বাইডেন প্রশাসন। এর পাশাপাশি বিমান, ট্যাঙ্কবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রসহ বহু ধরনের প্রাণঘাতী অস্ত্র দিয়েছে তারা। জ্যাভলিন অ্যান্টিট্যাঙ্ক, রকেট লঞ্চার, স্টিংগার অ্যান্টিক্রাফট মিসাইলও দিয়েছে। ন্যাটোর দেশগুলো ও তাদের মিত্ররা ঝাঁকে ঝাঁকে অস্ত্র পাঠিয়েছে কিয়েভে। এর মধ্যে শুধু জার্মানি ৪৫ হাজারের বেশি রকেট লঞ্চার ও স্টিংগার মিসাইল দিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক কয়েক বিলিয়ন ডলার অর্থ দিয়েছে তাদের অস্ত্র কেনা ও মানবিক সহায়তার জন্য।
কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ ঢালছে আইএমএফও। ইউক্রেন যুদ্ধের পরিণতি বিবেচনা না করেই ১৪০ কোটি ডলার সহায়তা অনুমোদন করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। বিশ্বব্যাংক দিয়েছে ৪৮ কোটি ৯০ লাখ ডলার। আর ইউরোপীয় ইউনিয়ন দিয়েছে এক হাজার ২০০ কোটি ইউরো। বিশ্বের ইতিহাসে কোনো আক্রান্ত দেশের জন্য এই বিপুল পরিমাণ অর্থ দেওয়ার নজির নেই। যুদ্ধ চলমান থাকার মধ্যেই এই অর্থ যে অস্ত্র কেনায় ব্যয় হবে, সেটি বোঝাই যায়। তা ছাড়া এই অর্থ ইউক্রেনের যুদ্ধকালীন সরকার কীভাবে ব্যবহার করবে, তার হিসাব-নিকাশ না করেই দেওয়া হচ্ছে।
প্রভাবশালী পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলো রাশিয়ার প্রধান নিরাপত্তা উদ্বেগকে উপেক্ষা করে শুধু পুতিনের আগ্রাসনকে বড় করে প্রচার করছে এবং পশ্চিমা দেশগুলোকে আরও অস্ত্র দেওয়ার জন্য উৎসাহ দিচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে রুশ সামরিক বাহিনীকে পরাজিত করার জন্য এসব অস্ত্র যথেষ্ট নয়। এ কারণে ইউক্রেনে এখন যত অস্ত্র সরবরাহ হবে, ততই যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হবে। যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর বিপুল পরিমাণ অস্ত্র সরবরাহের ফলে বেশি বেসামরিক মৃত্যু ও ধ্বংস হচ্ছে। এখানে একটি বিষয় পরিস্কার- ইউক্রেনকে পুতিন দখল করতে না পারলে পারমাণবিক যুদ্ধ বাধাতেও দ্বিধা করবেন না। এখন লক্ষ্য হওয়া উচিত, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ইউক্রেনীয়দের ওপর বিভীষিকা বন্ধ করা। তাই বিশ্নেষণ করা জরুরি- ব্যাপক পরিমাণ অস্ত্র সরবরাহে ইউক্রেনীয়দের ভাগ্যে কী ঘটবে।
মস্কো এখন দ্রুত প্রভাব বিস্তার করবে। এ অবস্থায় যে বিপুল পরিমাণ অর্থ ও অস্ত্র ঢালছে যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্ররা, তা থেকে বলা যায়, এই যুদ্ধ বন্ধ বা রাশিয়ার সঙ্গে শান্তি চুক্তিতে আসার সিদ্ধান্ত আর ইউক্রেনের হাতে নেই। তাই ইউক্রেন সভ্যতা বাঁচানোর সিদ্ধান্ত নিতে হবে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোকে। পশ্চিমা দেশগুলোর জনগণ এখন তাদের নেতাদের শুভবুদ্ধি জাগাতে চেষ্টা করতে পারে। কারণ তারা পুতিনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না।