মোঃ সিরাজুল মনির
চট্টগ্রাম ব্যুরো প্রধান
শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর চট্টগ্রামের একটা উন্নয়ন কাজের টেন্ডার থেকে মূল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বড় এমাউন্টের টাকার মাধ্যমে কাজটি এক সাব কন্ট্রাকটরকে দিয়ে দিয়েছে। মাঝে বরাদ্দের মূল একটা অংশ কাজ করা ছাড়াই নিয়ে গেল প্রতিষ্ঠানটি। এরকম সাব-কন্ট্রাক্ট প্রথা হাজার হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্পের লক্ষ্য অর্জনে বড় ধরনের অন্তরায় হয়ে উঠেছে। মূল ঠিকাদার কাজ না করে সাব কন্ট্রাক্টে অন্য ঠিকাদারকে কাজ দিয়ে দেয়ায় সংকট তীব্র হচ্ছে। হাত বদল এবং নানা অবৈধ লেনদেনে উন্নয়ন প্রকল্পের একটি অংশ হরিলুট হয়ে যাচ্ছে। ভেস্তে যাচ্ছে টেকসই উন্নয়ন। সাব কন্ট্রাক্ট প্রথা কড়াকড়িভাবে বাতিল করা না হলে ভবিষ্যতে দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বড় ধরনের হুমকির মুখে পড়বে বলেও আশংকা প্রকাশ করা হয়েছে। আবার এর সহ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অভিজ্ঞতা কম থাকার কারণে কাজের মান নিয়ে ও থাকে বিভিন্ন প্রশ্ন।
সূত্র জানিয়েছে, চট্টগ্রামসহ সারা দেশে উন্নয়নের মহাযজ্ঞ চলছে। হাজার হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে সারাদেশে। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম ওয়াসা, পানি উন্নয়ন বোর্ড, সড়ক ও জনপথ বিভাগ, বাংলাদেশ রেলওয়ে, চট্টগ্রাম বন্দরসহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থা হাজার হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। একটি উন্নয়ন প্রকল্পের ঠিকাদার নিয়োগ বেশ দীর্ঘ একটি প্রক্রিয়া। বিভিন্ন দিক যাছাই বাছাই করে ঠিকাদার নিয়োগ দেয়া হয়। ঠিকাদারকেও সংশ্লিষ্ট সংস্থার বিভিন্ন শর্ত পূরণ করে নিয়োগ পেতে হয়। একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অভিজ্ঞতা এবং ইক্যুইপমেন্ট বহর উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য অত্যাবশ্যকীয় একটি ব্যাপার। টেন্ডারে বিভিন্ন ধরনের শর্ত এবং যোগ্যতা প্রমাণ করেই একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান প্রকল্পের কাজটি পায়। দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা দেখে নিয়োগ দেয়া হলেও পরবর্তীতে দেখা যায় অনেকগুলো প্রকল্প ঝুলে রয়েছে। দফায় দফায় বাড়ানো হয় সময়। বাড়ানো হয় খরচ। উন্নয়ন কাজের সুফলতো দূরের কথা, বিভিন্ন সময় জনদুর্ভোগ চরমে ওঠে। বছরের পর বছর ধরে রাস্তার কাজ না হওয়া, ধুলোবালিতে শহর ভরিয়ে দেয়া হলেও পানি না ছিটানোসহ নানা ধরনের সংকট প্রকট হয়ে ওঠে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রকল্পের হাত বদলই এসব সংকটের মূল কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। চট্টগ্রাম মহানগরীতে হাত বদল হওয়া এমন প্রকল্পগুলোতেই জনদুর্ভোগ চরমে ওঠেছে। টেন্ডারে অংশ নিয়ে বিভিন্ন ধরনের যোগ্যতা প্রমাণ করে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ পেলেও তা পাঁচ থেকে ১০ শতাংশ লাভে সাব- কন্ট্রাক্টে বিক্রি করে দেয়। কাগজে পত্রে মূল ঠিকাদার থাকলেও প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের কাজ করে উপ ঠিকাদার। ডিজিটাল পদ্ধতি এবং ই-টেন্ডার সাব কন্ট্রাক্টরদের দৌরাত্ম্য ঠেকাতে পারছে না। সরকার হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করলেও প্রকল্প বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে উঠছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলেছে, সাব-কন্ট্রাক্টের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের যোগ্যতা যাছাই বাছাই করার সুযোগ থাকে না। মূল ঠিকাদারকে যত বেশি ছাড় দেয়া যাবে সেই সাব কন্ট্রাক্টরই কাজ পাবেন। এতে করে দশ শতাংশ পর্যন্ত লাভ দিয়ে ভ্যাট এবং ট্যাঙের ১৫ শতাংশ প্রদান করে শুরুতেই সাব কন্ট্রাক্টর ২৫ শতাংশ পিছিয়ে যায়। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করতেও প্রদান করতে হয় দুই থেকে পাঁচ শতাংশ পর্যন্ত অর্থ। এতে করে বাকি সত্তর শতাংশ অর্থ দিয়ে প্রকল্পের কাজ শেষ করা কঠিন হয়ে ওঠে। এভাবে টেকসই উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়।
অপরদিকে কাগজে পত্রে যেহেতু মূল ঠিকাদারই থাকে তাই বিল হয় মূল ঠিকাদারের নামে। মূল ঠিকাদার নানা পন্থায় প্রকল্পের বিল তুলে নেন। টাকা পয়সা আটকে ফেলেন। এতে করে সাব কন্ট্রাক্টর অনেক সময়ই অর্থের অভাবেও প্রকল্পের কাজে গতি আনতে পারেন না। টেন্ডারে অংশ নেয়ার যোগ্যতা নেই এমন প্রতিষ্ঠানগুলোই কাজ কিনে নিয়ে সাব কন্ট্রাক্টে কাজ করছে। এদের না থাকে পর্যাপ্ত ইক্যুইপমেন্ট। না থাকে পর্যাপ্ত অভিজ্ঞতা। এতে করে উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ তোলা সাব কন্ট্রাক্টরের পক্ষে সম্ভব হয় না।
প্রসঙ্গক্রমে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের অন্যতম প্রকল্প কর্ণফুলী নদীর ক্যাপিটাল ড্রেজিং নিয়ে বলতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেছেন, আন্তর্জাতিক দরপত্রে অংশ নিয়ে ‘ক্যাপিটাল ড্রেজিং ও ব্যাংক প্রটেকশন’ নামের প্রায় ২৩০ কোটি টাকার প্রকল্পটির কাজ পায় মালয়েশিয়া মেরিটাইম এন্ড ড্রেজিং কর্পোরেশন। কিন্তু তারা কাজ না করে স্থানীয় প্যাসিফিক মেরিন নামের একটি কোম্পানিকে সাব কন্ট্রাক্ট দেয়। প্যাসিফিক মেরিন নামের কোম্পানিটির এই ধরনের কাজের কোনো অভিজ্ঞতাই ছিল না। কর্ণফুলী নদী থেকে বালি উত্তোলন করে বিক্রি করার কাজ করতেন বালি জাফর নামের এক ব্যক্তি। তাকে যখন কর্ণফুলীর ক্যাপিটাল ড্রেজিং করতে দেয়া হয় তখনই ভাগ্য বিপর্যয় শুরু হয় কর্ণফুলীর। নানামুখী প্রতারণা এবং দুর্নীতির মাধ্যমে বন্দরের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে গা ঢাকা দেয় মালয়েশিয়ান কোম্পানি। একই সাথে লাপাত্তা হয়ে যায় প্যাসিফিক মেরিন। প্রকল্পটি ঝুলে যায়। বছরের পর বছর ধরে মামলা মোকদ্দমা চলতে থাকে। পরবর্তীতে বন্দর কর্তৃপক্ষ আইনি জটিলতা এড়িয়ে নতুন নামে নতুন প্রকল্প গ্রহণ করে।
শুধু কর্ণফুলীর ক্যাপিটাল ড্রেজিংই নয়, চট্টগ্রাম মহানগরীর রাস্তাঘাট উন্নয়নসহ বিভিন্ন প্রকল্পে সাব কন্ট্রাক্ট একটি বড় ধরনের যন্ত্রণা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেকগুলো রাস্তা ধানক্ষেতের মতো হয়ে থাকার পেছনে সাব কন্ট্রাক্টই দায়ী বলেও সূত্র মন্তব্য করেছে। রাঙ্গুনিয়া থেকে পানি আনার পাইপ স্থাপনের ওয়াসার একটি প্রকল্পও সাব কন্ট্রাক্টের কবলে পড়ায় বছরের পর বছর মানুষের ভোগান্তি চরম আকার ধারণ করছে। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের একাধিক রাস্তাও সাব কন্ট্রাক্টের কবলে। তবে কাগজে পত্রে কোথাও সাব কন্ট্রাক্টের নাম না থাকায় তাদের ধরা কিংবা তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয় না বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের একাধিক কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা বলেন, আমরা মূল ঠিকাদারের কাছ থেকেই কাজ বুঝে নিই।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, সাব কন্ট্রাক্টের কারণে বিভিন্ন প্রকল্পে সমস্যা হয়। টেন্ডারে এই সুযোগ বন্ধ করে দেয়া যায়। ‘সাব কন্ট্রাক্ট দেয়া যাবে না’ মর্মে টেন্ডারে উল্লেখ করে দেয়া হলে প্রকল্পের কাজ অন্য কাউকে দেয়ার সুযোগ ঠিকাদার পায় না। সাব কন্ট্রাক্টের সুযোগ থাকলে প্রকল্পের সমস্যা হওয়ার কথা তিনি স্বীকার করেন। তিনি সিডিএর কোনো প্রকল্পে সাব কন্ট্রাক্ট নেই বলেও দাবি করেন।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, সাব কন্ট্রাক্টের কারণে বিভিন্ন প্রকল্পে সমস্যা হয়। টেন্ডারে এই সুযোগ বন্ধ করে দেয়া যায়। ‘সাব কন্ট্রাক্ট দেয়া যাবে না’ মর্মে টেন্ডারে উল্লেখ করে দেয়া হলে প্রকল্পের কাজ অন্য কাউকে দেয়ার সুযোগ ঠিকাদার পায় না। সাব কন্ট্রাক্টের সুযোগ থাকলে প্রকল্পের সমস্যা হওয়ার কথা তিনি স্বীকার করেন। তিনি সিডিএর কোনো প্রকল্পে সাব কন্ট্রাক্ট নেই বলেও দাবি করেন।
জনৈক ঠিকাদার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, অনেক ঠিকানা আছে যারা শুধু তাদের ঠিকাদারি লাইসেন্স ব্যবহার কাজ নেয়ার পর বেশ কিছু টাকার বিনিময়ে লাইসেন্স ছাড়া ঠিকাদারদের হাতে কাজে অর্ডার তুলে দেয়। এসব তথ্য সংশ্লিষ্ট দপ্তর গুলো জানলেও তেমন কোন ব্যবস্হা নেননা।